যে রকম চাকরি করি , এই বছর যে বিয়েটা করবো বলে ৩ দিন আর হানিমুনটা করবো বলে ৫ দিনের লম্বা ২টো ছুটি পেয়েছিলাম এই ঢের। বড় ছুটির কথা আর মুখ ফুটে বলতেও পারিনি এর পর। কিন্তু বিধি বাম ১মাস যেতে না যেতেই পা সুর সুর আরম্ভ করে দিলো। এখনতো আর আমি একা নোই। অর্ধাঙ্গিনী সঙ্গে। কাছাকাছি উইকেন্ড ট্রিপের খোঁজ করতে করতে ফেসবুকে একটা গ্রুপ থেকে দারিংবাড়ী গোপালপুরের কথা শুনলাম। বন্ধুও জুটে গেলো দুজন। তাদের ফ্যামিলি আর আমার ফ্যামিলি মিলে টিকেট কেটে ফেলা হলো মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ৩ দিনের গোপালপুর ট্রিপের জন্য ।
এর আগেও একবার গোপালপুর এসেছিলাম আমি বন্ধুদের সাথে। কিন্তু এবার সাথে পরিবারের কয়েকজনও রয়েছে। অতএব ট্রিপের প্লানিংয়ে প্রথমেই একটা মেজর ফ্যাক্টর এসে গেলো “সাথে বয়স্ক মা-কাকিমা রয়েছে ”। হিসেবে মতো কমবয়েসী আমরা চারজন ইনক্লুডিং আমার সহধর্মিনী। আর বাকি চারজন বয়স্কের তালিকায়। প্রথমেই সেরে ফেলা হলো ট্রিপ শুরুর আগের একটা মস্ত বড় কাজ। যারা যাচ্ছি তাদের নিয়ে একটা হোয়াটস্যাপ গ্রুপ বানানো। এই কাজটা দায়িত্ত্ব নিয়ে করে ফেললাম আমি। ট্রেনের টিকেট কাটার দায়িত্ব ছিল পৌষালির উপর। টিকেটর খরচা যাতায়াত নিয়ে মাথা পিছু ২০০০ শুনে প্রায় পরে গেছিলাম চেয়ার থেকে কিন্তু তারপরেই মনে করিয়ে দেওয়া হলো সাথে বয়স্ক মানুষরা থাকবেন অতএব জেনারেলের টিকেট কেটে শতরঞ্চি পেতে তাস খেলতে খেলতে যাওয়া একদম চলবেনা। এসি কোচে ব্যবস্থা হয়েছে সবার। প্রতিবাদ করার ইচ্ছে একবার যদিও হয়েছিল এমাউন্ট দেখে কিন্তু চেপে গেলাম। আসলে ভাবলাম রাত ১২টায় সাঁতরাগাছি থেকে ট্রেন চেন্নাই মেল্ অতএব অফিস থেকে বাড়ি গিয়ে তারপর মা -বৌ কে নিয়ে বেরোতে হবে। দৈনন্দিন ল্যাধটা তাহলে ট্রেনে উঠেই খাবো। আর হ্যাঁ এসি কোচের একটা সুবিধে স্বীকার করতেই হয় যে যথেষ্ট পরিষ্কার পরিছন্ন আর টিকেটের দাম বেশি বলেই হোক আর যেকারোনেই হোক ভদ্রভাষায় যাদের আমরা মোদো - মাতাল বাওয়ালবাজ বলে থাকি সেরকম পাবলিকদের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। হোটেলের দায়িত্ব সদর্পে পালন করেছে শিল্পা , সেটাও এসি অতএব মে মাসে সি-বিচের ভুট্টা পোড়া গরমের হাত থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে মুটামুটি সবরকম ব্যাবস্থাই পাকা করে ফেলা হয়েছে। এরপরেও যদি কষ্ট হয় তাহলে ভরসা এলোভেরা জেল , সানস ক্রিম, পাউডার ইত্যাদি ইত্যাদি ।
রাত বারোটার চেন্নাই মেল্ সাঁতরাগাছি স্টেশনে এসে গেছিলো রাত এগারোটার মধ্যেই। অতএব মালপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে বেসামাল হওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়েনি। ডিনার করেই ট্রেনে উঠেছিলাম সবাই। এসি বগির ঠান্ডা আবহাওয়া , আই-আর-সি-টি-সির বালিশ কম্বলে শরীর এলিয়ে ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়তে কারোরই বেশি সময় লাগেনি। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে এই “কারোরি” বলতে আমি নিজেকে আর বৌকে বাদ দিয়ে বাকিদের বোঝালাম। আমাদের মতো যাদের ট্রেনে ঘুম আসেনা তাদের জন্য আমার বেস্ট উপায় পাওয়ার ব্যাঙ্কে লাগানো ইউএসবি লাইট জ্বালিয়ে গল্পের বই পড়া (স্পেশালি যাতে বাকিদের ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটে সিটের উপরে লাইট জ্বালিয়ে রাখার জন্য )। আর হ্যাঁ পৌষালি এটাও দেখিয়ে দিয়েছে পুরো আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়েও মোবাইল ঘাঁটা যায়, এটা আরেকটা উপায় ট্রেনে রাত্রীবেলা সময় কাটানোর। পার্সোনালি আমার একটা জিনিস খুব অদ্ভুত লেগেছিলো , সেটা হলো হরেক কিসমের লোকের হরেকরকম সুর তাল লয় মিলিয়ে নাসিকা গর্জন। ঘরর-ঘরর, ঘুঁ-ঘুঁ, ফোৎ-ফোৎ, কুই - কুই। থাক আর ডিটেলস ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা ।
সকালে উঠলাম যখন তখন ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে ভুবনেশ্বর স্টেশনে। ঘড়ি বলছে সময় সকাল সাড়ে সাতটা। অতএব আমাদের ট্রেন নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় ১ ঘন্টা লেট রান করছে। আই-আর-সি-টি-সির টি-ব্যাগের চা ব্যাপারটা নিয়ে কোনোদিনই আমার ভালো অভিজ্ঞতা হয়নি। এবারেও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি তবে ঠিক পরের স্টেশন খুর্দাবাদ রোডে একজন এমনি হকারের থেকে ১০ টাকার বিনিময়ে যে এলাচ চা খেয়েছিলাম সেটা সত্যি বেশ ভালো ছিল। গন্ত্যব্য ব্রহ্মপুর স্টেশনে পৌঁছাতে বেজে গেলো প্রায় ১১টা। স্টেশনের ফুড কোর্টে ৩০ টাকা পিসের যে পনির প্যাটিস দিয়ে আমরা ব্রেকফাস্ট সারলাম সেটা সত্যি ভালো। দেখে ভালো লাগলো আই-আর-সি-টি-সি অনুমোদিত হোটেলে ১৫ টাকায় জনতা মিলের ও বন্দোবস্ত আছে। স্টেশনের বাইরেই ছোট বড়ো সবরকমের গাড়ি পাওয়া যায় গোপালপুর যাওয়ার জন্য। আমরা ঠিক করলাম অটো। চারজন করে আরামসে বসা যায়। পিছনে মাল পত্র তুলে দিয়ে যাত্রা শুরু হলো। ৩০০ টাকা ভাড়া স্টেশন থেকে হোটেল অবধি। সময় লাগলো প্রায় ৪৫ মিনিট ।
হোটেল সি পার্ল আমাদের থাকার জায়গা। ডাবল বেড এসি রুম যেগুলো সমুদ্রের দিকে তাতে ট্যাক্স ধরে খরচ ২১০০ টাকা প্রতি রাত্রের জন্য। রাস্তার দিকের ঘর তুলনামূলক একটু সস্তা। অনলাইন বুকিং করতে হলে ৫০% টাকা আগে পাঠিয়ে দিতে হয়। ডাবল বেডরুমে যদিও আমরা তিনজন বেশ ভালোভাবে থেকেছি তবু হোটেলের সার্ভিস নিয়ে একটু খুঁত-খুঁতি থেকেই যাবে। কারণ রুমের সাইজ ছোটই। পৌষালীদের রুমের এসি দিয়ে ২৪*৭ জল পরেই চলেছে। আমাদের রুমের কোনো প্লাগ পয়েন্ট কাজ করে না। টিভি থাকলেও সেটা দেখার মেন্টালিটি কারোর ছিলোনা অতএব সেটা বাদ দিলাম। আর হ্যাঁ হোটেলে ওয়াই ফাই নেই আর ঘরের মধ্যে ভোডাফোন এয়ারটেলে টাওয়ার একটুও ধরছিল না যদিও আমার জিও খুব ভালো ভাবে চলেছে। বাথরুমের জল দিয়ে সব করা যাবে শুধু মুখ ধুতে গেলে বমি পেতে বাধ্য কারণ জল খুব লবনাক্ত। হোটেল থেকে খাবার জল যেটা দেয় সেটা জিওলিন দিয়ে খাওয়া যেতে পারে নাহলে ঠিক উল্টোদিকের দোকান থেকে ৩৫ টাকা দিয়ে ২ লিটারের মিনারেল ওয়াটার। তবে হ্যাঁ এটা ঠিক ছারপোকা বা চাদরে দাগ , নোংরা বাথরুম এরকম কোনো অভিযোগ করার জায়গা নেই। যেটা সবথেকে ভালো এই হোটেলে তা হলো সমুদ্রের দিকের সব ঘরে এক চিলতে বারান্দা রয়েছে যেখানে চেয়ার নিয়ে বসে সমুদ্র উপভোগ করা যায় সব সময়। তা ছাড়াও হোটেলের পিছনে বেশ বড়ো কমন বারান্দা আছে বসার ব্যবস্থা সহ। এবং এই কমন বারান্দা থেকেই সোজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়া যায় সি-বিচে। এটা ছাড়াও বিচের কাছাকাছি হোটেল কলিঙ্গ বেশ ভালো। আর ওটিডিসির হোটেল আছে তবে সেটার বুকিং পেতে গেলে নবরত্ন কবচ ধারণ করতে হবে ।
দুপুরের খাওয়া হোটেলেরই ডাইনিং রুমে। তথাকথিত ভেতো বাঙালির মাছ ভাতের প্রেম নিয়ে যতই জ্ঞান দেই না কেন লাঞ্চের মেনু কিন্তু আমাদের সেই ভাত ডাল আলু ভাজা আর মাছই ছিল। ২৫ টাকার ডাল যদিও জঘন্য স্বাদের তবুও সেটা পুষিয়ে দেবে ৮০ টাকা প্লেটের ২ পিস্ বড়সরো রুই মাছের ঝোল। ৪০ টাকার সাদা ভাতের প্লটে যে পরিমান ভাত থাকে তাতে ২প্লেট ভাত নিয়ে ৩ জন আরামসে খাওয়া চলে।
ট্রেনের ধকল সামাল দিতে পেট ভোরে মাছের ঝোল ভাত খেয়ে বাকিদের ইচ্ছে হলো একটু গড়িয়ে নেবার আমি আমার মা আর বৌ একটা ছোট গাড়ি ঠিক করে বেরিয়ে পড়লাম লোকাল সাইড সিইং করতে। ৪ জন বসার মতো ছোট নন এসি গাড়িতে করে সাইড সিইং করার খরচ ১৫০০ টাকা। প্রথমেই গেলাম তারা-তারিণী মন্দির। পাহাড়ের চুড়োয় মন্দির দেখতে গেলে পাহাড়ের নিচে গাড়ি রেখে ৫৯ টাকা টিকেটের রোপওয়েতে চড়তে হয়। তিন জনের টিকেট ১৮০ টাকা আর তার সাথে ৩ টে লজেন্স যেটা খুচরোর বিকল্প। মিনিট পাঁচেক লাগে চূড়োয় পৌঁছাতে। একটু ওপরে ওঠার পরেই পুরো ভ্যালি টার একটা সুন্দর সিনারি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। দূরে সার দিয়ে ধাপে ধাপে পাহাড় , প্রায় শুকনো ঋষিকুল্লা নদী আর ঠিক আমাদের সামনেই পাহাড়ের উপর তারা-তারিণী মন্দির।
স্থানীয় ইতিহাস দাবী করে এ মন্দির প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরোনো। নতুন ভাবে প্লাস্টার করে আপ্রাণ চেষ্টা চলছে মন্দির বাঁচিয়ে রাখার। নতুন প্লাস্টারের উপরে বসানো পাথরের মূর্তি গুলি যে খুবই প্রাচীন সেটা বুঝতে সমস্যা হয়না। আর মূর্তির সংখ্যা কয়েকশোর বেশি হলেও আশ্চর্য্য হবো না। হনুমান, ব্রহ্ম, রামায়ণের চরিত্রের পাশাপাশি অনেকগুলো বুদ্ধমূর্তি চোখে পরে। আর তারই মধ্যে আছে সম্রাট অশোকের মার্কামারা সিংহ মূর্তি। ইতিহাস বলে ওই বুদ্ধ মূর্তি আর সিংহ মূর্তি গুলি সম্রাট অশোক কর্তৃক স্থাপিত। মন্দিরের আকারের সাথে বিখ্যাত সূর্য মন্দিরের আদল পাওয়া যায় কিছুটা যদিও আকারে তার থেকে অনেক ছোট এই তাড়াতাড়িনী মন্দির। ঠিক মূল গৃহে প্রবেশের মুখে প্রবেশ দ্বারের সামনেটায় বিগ্রহের দিকে মুখ করে বসানো আছে অশোক স্থাপিত সিংহ মূর্তি। হনুমান আর পান্ডাদের উপদ্রব বাদ দিলে ৪০ টাকার পূজোর ডালা নিয়ে পূজো দিয়ে মা -বৌ যেমন খুশী আমিও ততটাই খুশি পড়ন্ত বিকেলে পাহাড়ের উপর থেকে বেশ কিছু ভালো ছবি তুলে। রোপ ওয়ে বন্ধ হয়ে যায় বিকেল ৫ টা ৩০ এ। তাই খুব ইচ্ছে করলেও সানসেট অবধি থাকার উপায় নেই। রোপওয়ে দিয়ে নেমে এসে নিচের ক্যাফে থেকে বিকেলের চা খেয়ে নিলাম। এর পর দেখার জায়গা সাঁইবাবা মন্দির আর কালুয়া দেবীর মন্দির।
গাড়িতে উঠে ড্রাইভারের কথায় একটু মন দোমে গেলো যে এখন প্রায় ৬ টা বাজে অতএব বাকি দুটি মন্দিরই বন্ধ হয়ে গেছে। তাই হোটেলে ফিরে যাওয়াই অগত্যা। ড্রাইভারের মুখেই একটা গল্প শুনলাম যেটা এই তালে বলে নি। সত্যি মিথ্যে জানিনা বাপু তবে পিওর ঢপ হলেও শুনতে যে ভালোই লাগলো সেটা মানতেই হবে।
ধৌলি পাহাড়ের পাদদেশে , দোয়া নদীর তীরে তখন যুদ্ধ প্রায় শেষ মুখে। মৌর্য্য বংশের সম্রাট অশোক আর কলিঙ্গের রাজা অনন্তর সৈন্য বাহিনীর মধ্যে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল বীভৎসতায় তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। পরাজয় নিশ্চিত বুঝে গুপ্তচর মারফত খবর পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাজা অনন্তর অন্তঃপুরে। রানী তখন রাজবাড়ীর সব নারীদের নিয়ে রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লেন রিশিকুল্লা ধারে পাহাড়ের উপর তাড়াতাড়িনী মন্দিরের উদেশ্যে। এই বিপদে মা তাঁরাই ভরসা। ওদিকে অশোকের সৈন্যবাহিনীর একাংশ তখন কলিঙ্গ নগর লুঠপাট করতে ঢুকে পড়েছে। তাদের কাছেও খবর পৌছালো রাজ্ রমনীদের পাহাড়ে আত্মগোপন করার কথা। অত্যুৎসাহী সৈন্যদল পিছু নিলো নারী বাহিনীর। ওদিকে রানীমা তখন সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মন্দিরের গর্ভ গৃহে। অশোকের সৈন্যদল পৌছালো পাহাড়ের পাদদেশে। হিংসান্মত্ব সৈন্যবাহিনীর মধ্যে তখন লালসা তীব্র হয়ে উঠেছে। কিন্তু বিধি বাম। যেদিকেই যায়না কেন পথ আটকে দাঁড়ায় ত্রিশূল হাতে এক দেবী। চোখ তাঁর জ্বলছে আগুনের মতো। দেবীর তেজ অনুভব করে কেউ আর সাহস পায়না পা বাড়ানোর। অবশেষে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে যায় উন্মত্ত সৈন্য বাহিনী। সম্রাট অশোকের কানে যখন এই দেবীর কাহিনী পৌঁছায় ততক্ষনে তাঁর বোধোদয় ঘটে গেছে। যুদ্ধের ধ্বংসলীলা ছেড়ে তাঁর মন তখন বুদ্ধের প্রেমের বাণীতে আকৃষ্ট হয়েছে। মন্দির পরিদর্শনে এলেন স্বয়ং সম্রাট। হিন্দু মন্দিরে দেবী মূর্তি রইল তার সাথে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেলেন ভগবান বুদ্ধের মূর্তি।
হোটেল যখন ফিরে এলাম তখন প্রায় ৭ বাজে। ঘন্টা দেড়েক লাগলো ৩৫ কিলোমিটার দূরের তারিণী মন্দির দেখে ফিরতে। কারন রাস্তায় জ্যাম। দলের বাকিরা তখন বিচে বসে আড্ডা জমিয়েছে। পুরী -দিঘার বিচ আমি দেখেছি অনেকবার। চোখে পড়ার মতো পার্থ্যক্য হলো এই গোপালপুরের বিচ সেই তুলনায় অনেক শুনশান। এক জায়গায় হাতে গোনা কয়েকটা ডাব , চা , ঝালমুড়ির দোকান ছাড়া বিচের উপর মাত্র ৩ টি খেলনা-পাতির দোকান। পুরী দীঘার মতো প্রতি ৩০ সেকেন্ডে কানের সামনে এসে কেউ চা চা বলে অতিষ্ট করবেনা। রাস্তার আলোর থেকে একটু হেটে গেলেই তারপর পুরো অন্ধকার বিচ। রাত ১০টা ১১ টা যতক্ষণ ইচ্ছে বসে থাকা যায় বিচে। একদল টুরিস্ট ছোকরা কে দেখলাম অন্ধকারের মধ্যে বসেই দারু খেয়ে চলেছে। বেশী ঝামেলা কিছু না হলে কাছের পুলিশ স্টেশন এই ব্যাপারে কোনো নাক গলায় না বোধহয়। আমাদের হোটেল থেকে একটু পিছিয়ে এলেই চোখে পরে গোপালপুরের বিখ্যাত লাইট হাউস। শুনলাম দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই গোপালপুর ছিল মিত্র শক্তির অন্যতম বড়ো নৌ ঘাঁটি। সেই সময়েই বানানো হয়েছিল এই লাইট হাউস। এখন আর প্রাকটিক্যাল কোনো ব্যবহার নেই তবে টুরিস্টদের জন্য সন্ধ্যার দিকে ঘন্টা কয়েক এখনো জ্বালিয়ে রাখা হয়। হাত ভালো থাকলে রাতের অন্ধকারে লাইট হাউস নিয়ে ভালো ছবি আসতে পারে ।
রাতের খাবার খেতে বসলাম আন্দাজ ১০টা নাগাদ। দুপুরে মাছ হয়েছে , বেড়াতে এসে একটু মাংস না হলে চলেনা তাই রাতের বেলা চিকেন। তার সাথে কেউ ভাত কেউ রুটি। ১০০ টাকা প্লেটের দাম। ৩পিস্ ভালো সাইজের চিকেন আর যথেষ্ট পরিমানে কষা কারী। খেতে একদম মাখো মাখো। জিভের উপর লাগাম রাখা কষ্টকর। রাতের খাবারের পর প্রায় ফাটো ফাটো ভুঁড়ি নিয়ে একবার ভেবেছিলাম বিচ থেকে ঘুরে আসি। কিন্তু কাল আবার সাত সকালে বেরোনো। কালকের গন্ত্যব্য দারিংবাড়ী। উড়িষ্যার কাশ্মীর ।
সাত সকালে না হলেও সাড়ে সাতটার মধ্যে বেরিয়ে পড়া হলো সদলবলে। আমি অবশ্য এর মধ্যেই ভোর বেলা বেরিয়ে সান-রাইসের সময় সমুদ্র নিয়ে বেশ কিছু সোনালী ছবি তুলে ফেলেছি। এসি গাড়িতে দারিংবাড়ী ঘুরে সন্ধ্যায় ফিরে আসা অবধি ভাড়া ৪৫০০। বড়ো গাড়ী ছিল। আমরা আটজন বেশ আরামেই জাঁকিয়ে বসলাম। শহর পেরিয়ে গ্রামের রাস্তা পড়তে বেশিক্ষন লাগলো না। দুপাশে মালভুমি , দূরে ছোট বড়ো পাহাড় আর তার মাঝ দিয়ে পিচবাঁধানো রাস্তার শোভা সত্যি ভোলার মতো নয় ।এসি গাড়িতে ছিলাম বলে বাইরের গরম আমাদের কোনো অসুবিধা করেনি। রাস্তার মধ্যে মধ্যে হ্যাম্পসের ঝাঁকুনি টুকু বাদ দিলে এরম মাখনের মতো রাস্তা সত্যি বিরল। বিশ্বাস করানো শক্ত যে পুরো রাস্তায় একটাও গাড্ডা চোখে পড়েনি। গোপালপুর থেকে দারিংবাড়ীর দূরত্ব প্রায় ১৩৫ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগে প্রায় ৩ ঘন্টা। ৯ টা নাগাদ একটা বাজারের মধ্যে গাড়ী দাঁড়ালো। দোকান দেখে ভক্তি না এলেও লুচি তরকারি আর চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট ভালোই হলো আমাদের। মানতেই হবে ২০ টাকা প্লেটের ৪টি ঘুগনি সহযোগে লুচি বেশ উপাদেয়। বেলা ১০টা নাগাদ জঙ্গলের রাস্তা শুরু হলো। আমার ক্যামেরার হাত সুরসুর করতে শুরু করায় গাড়ী দাড় করানো হলো রাস্তার পাশে। ইঞ্জিন থামতেই কানে ভেসে এলো একটানা ঝিঁঝি পোকার ডাক। মুহূর্তে মনটা ভালো হয়ে গেলো প্রকৃতির কোল অনুভব করে। চারিদিকে সবুজ জঙ্গলের মাঝে সরু একফালি পিচের রাস্তা। মিনিটে কি দু মিনিটে একটা গাড়ির দেখা পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ ।
সেলফি, গ্রুপফি, ল্যান্ডস্ক্যাপ, পোট্রেট ইত্যাদি বাঘা বাঘা ক্যাটাগরির ফোটোগ্রাফি শেষ করে আবার রওনা দিয়েছি আমরা। জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে ঘোরানো রাস্তা সমানে উপরে উঠেই চলেছে। অবশেষে প্রায় ১১টা নাগাদ এসে পড়লাম দারিংবাড়ীর ড্যাসিং ঝর্ণার সামনে ।
স্থানীয় দের কাছে জায়গাটার নাম লাভার্স পয়েন্ট। ঝর্ণার জল গেছে একটা ফুটবল মাঠের মতো বড়ো পাথুরে জমির উপর দিয়ে। শীতকাল হলে নিঃসন্দেহে বসে বেশ কয়েক ঘন্টা সময় কাটানো যেত। আদপে যেটা হলো অলমোস্ট সবার পায়ে ফোস্কা পরে গেলো গরম পাথরে হাঁটার ফলে। বেশ কিছু ছবিও তুললাম এই জায়গায় যদিও সবই নিজেদের ছবি। ক্যামেরার সর্বোচ্চ সাটার স্পীড আর সিপিএল ফিল্টারও ব্যর্থ এই গনগনে রোদের মধ্যে সুন্দর জঙ্গলে ঘেরা পাথুরে জায়গাটার একটা কমপ্লিট ল্যান্ডস্ক্যাপ ফটো তুলতে ।
এর পরের দ্রষ্টব্য এমু পাখির খামার। দেখতে নামলাম। উট পাখির ছোট সংস্করণ এই এমু। উইকিপিডিয়ার মতে উট পাখির মতো উগ্র চন্ডা নয়। বরং শান্ত স্বভাবের পাখি। এক বুড়ো ছিল খামারের গার্ড হিসেবে। তার হাত থেকে দানা নিয়ে শিল্পা এমু কে খাইয়ে যা সাহস দেখালো তাতে একটা নোবেল না হোক কদবেল পুরস্কার ওর প্রাপ্য। আমার তো পাখিগুলোর গলার আওয়াজ শুনেই কাছে যেতে সাহস হলো না। কুকুর অনেক সময় গলার মধ্যে ঘড় ঘড় আওয়াজ করে একটা, এ যেন সেইরকম ডাক। চাপা গর্জন। সব থেকে অবাক লাগল এমুর ডিম। আমরা যেটা দেখলাম সেটা ওজনে প্রায় 400 গ্রাম। দেড় কেজি পর্যন্ত ওজন হয় নাকি। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ডিমের রং পুরো ডিপ সবুজ। এরকম ডিম দেখা সত্যি এক নতুন অভিজ্ঞতা। আর হ্যাঁ ওমলেট, সেদ্ধ, ভুজিয়া এইসব ও বানিয়ে দেওয়া হয় এখানে, মুটামুটি দাম ৩০০ টাকা প্রতি ডিম পিছু। বানানোর খরচ আলাদা।
ওখান থেকে যখন বেরোলাম সবারই খিদে পেয়ে গেছে। কারণ ঘড়ি বলছে প্রায় 2 টো। এই একটা ব্যাপারে দারিংবাড়ী পুরো ফেল মেরে দিলো। হিল-টপ রেস্তোরাঁতে খাবার বলতে ফিশ মিল। ৯০ টাকার বিনিময়ে থালায় করে ভাত, ডাল, তরকারি আর মাছ যা দিলো তার কোনোটাই মুখ দিয়ে আর গলায় নামেনা। এখানে আসার আগে শুনেছিলাম এই রেস্তোরাঁতে নাকি পদ্ম পাতায় খেতে দেয়। আমাদের ড্রাইভার বাবাজীবন পাশের টেবিলে বসে কব্জি ডুবিয়ে পান্তা ভাতের মতো কি একটা সাঁটাচছিলেন , সেটা পাতায় করে দেওয়া হয়েছিল। পদ্মপাতা না হয়ে বিড়ি পাতাও হতে পারে, তবে পাতা যে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এরম বাজে লাঞ্চ খেয়ে সবাই যে বেড়ানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে তাতে আর আশ্চর্য কী।
যাই হোক , ফেরার পথেই পড়বে বলে দাঁড়ানো হলো কফি প্লান্ট আর গোলমরিচের প্লান্টে। কোনটা কফি গাছ সেটা মা গঙ্গা জানেন, গোলমরিচ গাছ চেনা গেল গন্ধ শুঁকে। সংরক্ষিত জঙ্গলের মধ্যে ছায়া থাকাতে জায়গাটা বেশ মনোরম। গাছ গাছালি নিয়ে বেশ কিছু ছবিও তুলে ফেললাম এখানে। ঢোকার টিকেট ছিল ৫ টাকা করে , বেরোনোর সময় দেখলাম টিকেট কাউন্টারের পাশে ফার্মের গোলমরিচ আর রোস্ট না করা কফি বিন্স বিক্রী হচ্ছে । গোলমরিচের ১৫০ গ্রামের প্যাকেট ১০০ টাকা। আমার মায়ের মতে ১৫০ র কম রয়েছে প্যাকেটে কিন্তু গন্ধ শুঁকেই বোঝা যাচ্ছে খাঁটি মাল।
আর কিছু দেখার এনেরজি নেই, ঘড়ি বলছে প্রায় 4 টে, এখুনি রওনা দিলেও গোপালপুর পৌঁছাতে 7 তা বাজবে। ফেরার পথে সান সেটের একটা মনোরম দৃশ্য দেখে গাড়ি থামিয়েছিলাম। চেষ্টা করেছি ক্যামেরা বন্দি করার।
সন্ধেয় হোটেল ফেরার পর আর কাজ বেশি কিছু নেই কাল রবিবার, ফেরার ট্রেন ১২ টা ৪০। অঙ্গ এক্সপ্রেস। বাকি সময়টা কাটবে তোলা ছবি গুলো নাড়া চারা করে।
ফেরার ট্রেন সেই ব্রহ্মপুর থেকেই বেলা ১২ তা ৪০ এ । অতএব হোটেল ছেড়ে বেরোতে হবে ওই ১১ টা নাগাদ । হোটেলের চেকআউট টাইম যদিও সকাল ৯টা তবে কয়ে সেটা বাড়িয়ে নেওয়াই যায় । ব্র্যাকফাস্টে মাখন পাউরুটি টোস্ট আর ওমলেট । ৩০ টাকা প্লেটের মাখন পাউরুটি তে মাখনের গন্ধ স্নিফার ডগও পাবে কিনা সন্দেহ আছে তবে ওই যেহেতু সাথে ডিমের ওমলেট আছে তাই নেমে গেলো কোনোরকমে গলা দিয়ে । হোটেল থেকে স্টেশন এলাম একটা ছোট বাসে করে খরচ ৭০০ টাকা , আসার সময় ২ টো অটো মিলে পড়েছিল ৬০০ টাকা । কিন্তু হোটেলে থাকলে হোটেলের গাড়িই নিতে হবে । অটো ওয়ালাকে আলাদা করে বলেও রাজি করাতে পারিনি ।
ব্রহ্মপুর স্টেশনের ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমটা কিন্তু খাসা । আরাম কেদারা তাকিয়া রাখা আছে ।লেডিসদের জন্য আলাদা রুম । বাথরুম তাও খুব পরিষ্কার পরিছন্ন । তবে হ্যাঁ এসি নেই যেটা জেনেরালি ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে থাকে । ট্রেন শুনলাম ১ ঘন্টা লেট রান করছে । অতএব ট্রেন আস্তে প্রায় ২ টো ।এখন ঘড়িতে ১২:৩০। সময় কাটাতে ঠিক করলাম সবাই মিলে লাঞ্চটা সেরে ফেলি । রোদের তেজ দেখে পৈতৃক প্রাণের মায়ায় আর স্টেশন চত্বর থেকে বেরোনোর সাহস হলো না । ফুড কোর্টে আসার দিন পনির প্যাটিস ভালো খেয়েছিলাম সেই ভরসাতেই সবাই ঢুকে পড়লুম ফুড কোর্টে। কেউ ফিশ মিল(৮০ টাকা ) কেউ চিকেন মিল(১২০ টাকা ) আমার মতো বিরিয়ানি খেঁকো রা চিকেন বিরিয়ানী(১২৫ টাকা ) । বিরিয়ানিতে শুকনো লংকার ঝাঁঝ টা বড্ড বেশী আর মিলের খাবারে রাইসের পরিমান যারা ডায়েট করে তাদের জন্য একদম ঠিক এছাড়া আর কোনো অভিযোগ করার যায়গা নেই ।
খেয়ে উঠতে উঠতে ট্রেন বলে দিয়েছিলো ।আর কিছু উল্লেখ যোগ্য ঘটেনি তাই আর লেখা বড়ো করছিনা শুধু এটুকু বলি ট্রেনটা হাওড়া ঢুকিয়েছে রাত ১১:৪৫ এ । আগে থেকে গাড়ির ব্যবস্থা না করা থাকলে সেই রাত আমাদের হাওড়া স্টেশনেই কাটাতে হত ।








Post Collected and Photo Credit  : 
Sahasrangshu Guha